এইচএম জাকির, ভোলা ॥ ভোলার বিভিন্ন সড়কে চলছে ইজিবাইক, অটোরিকশা ও বোরাকসহ ব্যাটারিচালিত ৩০ হাজারেরও বেশি যানবাহন। লাইসেন্সবিহীন এসব ছোট যানের কারণে একদিকে সড়কে শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, একই সঙ্গে চাপ বাড়ছে জাতীয় গ্রিডে। কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দিন দিন বাড়ছে এসব বিদ্যুত্চালিত যানবাহন, গড়ে উঠছে প্রস্তুত ও মেরামতের কারখানা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুধু ভোলা পৌর এলাকাতেই প্রধান সড়কের দুপাশে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে ব্যাটারিচালিত যানবাহন তৈরির কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন নতুন করে ৩০ থেকে ৪০টি বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারিচালিত যান রাস্তায় নামছে। অথচ এ ধরনের যানবাহন তৈরির লাইসেন্স এসব প্রতিষ্ঠানের নেই। দেখা গেছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই আগে স্টিলের ফার্নিচার তৈরি করত, এখন তাদের একমাত্র কাজই এসব যানবাহন প্রস্তুত ও মেরামত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাত-আট বছর আগেও ভোলার দুয়েকজন ব্যবসায়ী আমদানিকারকদের মাধ্যমে ব্যাটারিচালিত বোরাক, অটোরিকশা আমদানি করতেন। দ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় কয়েক বছরের মধ্যে বেড়েছে ব্যবসার পরিধি, বেড়েছে দোকানের সংখ্যা। বর্তমানে জেলার সাত উপজেলায় এ ধরনের যানবাহন তৈরি এবং বিক্রির প্রতিষ্ঠান রয়েছে শতাধিক। শহরের উকিলপাড়া এলাকার ‘অনুকা স্টিল’। কয়েক বছর আগেও তারা স্টিলের ফার্নিচার তৈরি করত। এরই মধ্যে ব্যাটারিচালিত যানবাহন তৈরি ও বাজারজাত করে রীতিমতো কোটিপতি বনে গেছে। তবে তারা এ ধরনের যানবাহন তৈরি এবং বিক্রি করার কোনো অনুমতিপত্র দেখাতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির মালিক হুমায়ন কবিরের দাবি, এর জন্য লাইসেন্সের দরকার হয় না। এত বছর ধরে ব্যবসা করছেন, কোনো সমস্যা হয়নি। পাশেই ‘রাজধানী মেটাল’ নামে প্রতিষ্ঠানটিও স্টিলের ফার্নিচার তৈরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন দোকানে ব্যাটারিচালিত যানবাহনসহ এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের সমাহার। এসব তৈরি ও বিক্রির অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে এড়িয়ে যান দোকানের মালিক। একই ভাবে শিপন মটরস্, জেনারেল ষ্টোর, অনুকা ষ্টীল, প্রাইম মটরস্, জাকির ট্রেডার্স, প্রতিবেশি ও গ্রামীন মটরস্সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অল্প কয়েক দিনেই এ ব্যবসায় পাল্টে গেছে তাদের অর্থনৈতিক চিত্র। স্থানীয়রা বলছেন, ভোলা শহরে এখন আর স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করা যায় না। রাস্তায় চলাচল করতে মানুষকে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেকে। অধিকাংশ সময়ই রাস্তা পার হতে দাড়িয়ে থাকতে হয় মিনিটের পর মিনিট। আর ছোট বড় দুর্ঘটনাতো প্রতিটি মূহুর্তেই লেগে আছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক এ্যাডভোকেট নজরুল হক অনু বলেন, ভোলায় নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে বাড়ছে ব্যাটারি চালিত যানবাহন। কিছু দিন আগেও রাস্তা পারাপারে পথচারীকে দাড়িয়ে থাকতে হতো না। কিন্তু এখন রাস্তা পারাপারই নয়, চলাচলেও মানুষের ভোগান্তী বেড়ে গেছে কয়েক গুন। জেলা হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স ফোরামের সভাপতি মোবাশ্বির উল্লাহ বলেন, বছরখানেক আগেও ভোলায় প্যাডেল রিকশায় চলাচল করেছি। এখন নেই, সবই ব্যাটারিচালিত। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শহরের বাজারগুলোতে। এগুলোর ভিড়ে বাজার কিংবা রাস্তায় চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে পৌরসভা কিংবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে এর দৌরাত্ম্য। জেলা বিআরটিএর এক জরিপে দেখা গেছে, ভোলা জেলার সাত উপজেলায় ৩০ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন এ ধরনের যানবাহন বৃদ্ধির ফলে ঘটছে ঘন ঘন দুর্ঘটনা, সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এসব যান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ উল্লেখ করে জেলা বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এমডি শাহ আলম বলেন, আমরা শুধু মোটরযানের লাইসেন্স দেই। এ ছোট যানগুলো কিছু রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় চলে। পৌরসভার পক্ষ থেকেও এসব নিষিদ্ধ যানবাহনের লাইসেন্স দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে ভোলা পৌরসভার লাইসেন্স পরিদর্শক মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ভোলার ইউনিয়নগুলো বাদে শুধু পৌর এলাকায় আট হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৩৮টির লাইসেন্স রয়েছে। বাকিগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি। এদিকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় চাপ বাড়ছে ভোলার বিদ্যুৎ লাইনে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, একটি বোরাকে মাসে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়, ব্যাটারিচালিত রিকশায় খরচ হয় ২০০ থেকে ২৫০ ইউনিট। সে হিসাবে জেলার ব্যাটারিচালিত প্রায় ৩০ হাজার যানবাহনে মাসে অন্তত ৬০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। এসব যানবাহনের সংখ্যা এভাবে বাড়তে থাকলে ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ, ওজোপাডিকো লিমিটেড ভোলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী দুলাল চন্দ্র ঘোষ। গরমের সময় লোডশেডিংয়ের এটিও একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি। তবে শুধু জেলা প্রশাসনের একক চেষ্টায় এসব যান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় উল্লেখ করে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল হালিম বলেন, আমরা সহযোগী হিসেবে কাউকে কাছে পাই না। পুলিশ প্রশাসন, পৌরসভা এবং রাজনীতিকরা সহযোগিতা করলে ১ ঘণ্টার অভিযানেই এ ধরনের যানবাহন বন্ধ করা সম্ভব বলে দাবি করেন তিনি।
Leave a Reply